এক সাময়িকীর সম্পাদকের তাগাদা পেয়ে লিখেছিলাম। তিনি তা ছেপেছেন। কিন্তু সংশয় এড়াতে পেরেছেন, এমনটি মনে হয়নি। আর একটি কাগজের সম্পাদক নিজের মতো করে অর্ধেক ছেপেছেন, তাও সংশয় থেকে। কোন সে অদৃশ্য হাতের কন্ঠ রোধে এমন সংশয় বর্তমানে, সেটুকু সুহৃদদের কাছে বিনীত জিজ্ঞাসা। কারন বাঙালি সংস্কৃতির উন্মেষ এবং বর্তমান বাস্তবতা যেভাবে দেখেছি, সেটুকুই প্রকাশ করার চেষ্টা। এমন বাস্তবতা প্রকাশে কোনো সংশয় থাকতে পারে, আমার তা মনে হয়নি। একান্ত সুহৃদদের জন্য আজকে থাকলো সেটুকু।
***************************
সংস্কৃতির মৃত স্মারকে উৎসবহীন নিঃস্ব বাঙালি।
——————————————————————
কোনো জনগোষ্ঠী, সমাজ এবং জাতির জীবনবোধের বাহক তার নিজস্ব সংস্কৃতি এবং উৎসব। প্রকৃত মুল্যবোধ নিহিত তার সংস্কৃতির মাঝেই। যার চর্চা এবং উৎসবের মাধ্যমে প্রকাশ ঘটে একক এবং সমষ্টিগত মুল্যবোধের। উন্মুক্ত হয়ে উঠে ভাবনা উৎকর্ষতার পথ। একই সাথে বর্তমানে দাঁড়িয়ে প্রতিনিয়ত নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি সহ অনির্ধারিত, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের নানা সংশয়, সম্ভাবনার ভাবনাও চালিত করে মানুষকে। সেই ভাবনা থেকে উদ্ভব ভিন্ন ভিন্ন নানা উপাদান যোগ হতে থাকে চলমান নিজস্ব সংস্কৃতির সাথে। মূল সংস্কৃতির সাথে যোগ হয়ে সে সব উপাদান কোনো সংস্কৃতিকে করে সমৃদ্ধ, কোনোটা পড়ে মুখ থুবড়ে। থুবড়ে পড়া মূল সেই সংস্কৃতি একসময় হারিয়ে যায় এবং ভিন্ন কিংবা বাহির উপাদানই হয়ে উঠে ঐ সমাজ বা জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক পরিচয়। এভাবে পৃথিবীতে অঞ্চল ভেদে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং আধিপত্য বিস্তারকারী উপাদানের নাম; ধর্ম।
মানব সভ্যতা ক্রমবিকাশের পথে প্রায় ছয় হাজার বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন সমাজে, বিভিন্ন রূপে আবির্ভাব ঘটেছে ধর্মের। ইহজাগতিক সকল প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে সম্ভাব্য সুখের সাথে পরকালীন চির অমরত্ব লাভ; মানুষের অন্তর্গত এক তীব্র সহজাত আকাঙ্খা। ধর্মের উৎপত্তি এবং ধর্মের মাঝেই তা প্রকাশের অনিবার্য রূপ পৃথিবী দেখে চলেছে প্রায় ছয় হাজার বছর ধরে। এবং বর্তমান পর্যন্ত চার সহস্রাধীক ধর্মের উৎপত্তি ঘটেছে পৃথিবীতে। মানুষ তার নিজ নিজ ধর্মের ভাষায় নির্মাণ করে রেখেছে চিরকালীন বেঁচে থাকার সেই কাল্পনিক জগৎ। প্রত্যেক ধর্মের আলাদা নকশায় আঁকা সে জগৎ চিত্র। সাধারণের সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজে সবচেয়ে বেশি কার্যকর অলীক এই বোধ। এই বোধের অনিবার্যতায় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে নিজস্ব মূল সংস্কৃতি হারিয়ে ধর্ম নির্ভর জীবনাচারে রচিত পরিমন্ডল হয়ে উঠেছে সেই অঞ্চল বা সমাজের সাংস্কৃতিক পরিচয়। ধর্মপ্রবণ এই সমাজে মানুষের ভাবনা এবং তার প্রকাশ নির্দিষ্ট সীমারেখায় আটকানো, অবিকশিত। পক্ষান্তরে আবহমানকালের নিজ সংস্কৃতি ধারন করে, উৎকর্ষতার পথে এগিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি প্রবন সমাজের মানুষ; দিকচক্রবাল ভাঙতে চেয়েছে, ওপারে কি আছে তা দেখতে চেয়েছে, বিকশিত হতে চেয়েছে এবং বিকশিত হয়ে উঠেছে।
আমাদের বাংলা ভূখণ্ড অত্যান্ত প্রাচীন জনপদ। যার ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক রূপ, জীববৈচিত্র্য, ভূমির উর্বরতা সহ নানা সম্ভাবনা ও সম্পদের লোভে, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নৃতাত্ত্বিক নানা গোষ্ঠীর আগমন ঘটে। সময় গড়ানোর সাথে সেই সব জনগোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য একাকার হয়ে এই ভূখন্ডে গড়ে উঠে অভিন্ন জীবনধারা, সংস্কৃতি এবং ভাষা। এভাবে আগত বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মিশ্রণে আমাদের সমষ্টিগত পরিচয় বাঙালি হিসেবে নির্ধারিত হয়ে যায়। জন্মলাভ করে বাঙালি জাতি। এই পরিচয় এবং সংস্কৃতি হয়ে উঠে আমাদের একান্ত নিজের। তারপর নানা ক্ষেত্রে কমবেশি পরিবর্তন ঘটলেও, নিজ সংস্কৃতির চর্চা উৎসবে একাত্মবোধ জাগিয়েই চলতে থাকে বাঙালির প্রকৃত জীবনবোধের ধারা। সুদীর্ঘ কাল সেই ধারা’ই আঁকড়ে ছিলাম আমরা।
জাতিগঠনের সেই সূচনালগ্ন থেকেও সংস্কৃতির উপর ধর্মের আগ্রাসী সামাজিক অবস্থার ইতিহাস আমাদের জানা। কিন্তু সে সময় ধর্ম কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির উপর দাঁড়াতে পারেনি। ধর্ম ছিল একান্তই ব্যক্তি এবং পারিবারিক গন্ডিতে। তবুও ধর্মের সেই গন্ডি ব্যবহার করেই দুর্ধর্ষ বর্ণ প্রথায় পিষ্ট করেছে মানুষকে, মনুষ্যত্বকে এবং আটকাতে চেয়েছে চিন্তার বিকাশ। বর্ণ প্রথার নিষ্ঠুর নিপিড়ন ভোগ করতে হয়েছে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারনকে। ধার্মিকের মুখোশে,ধর্মের নামে নানা কুসংস্কারে নিমজ্জিত রেখেছে তাদের। কিন্তু ধর্মের বাইরে বাঙালির মূল সাংস্কৃতিক যে উৎসব, তা পালনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে উঠতে পারেনি কখনো।
ভিন্নমত থাকলেও, বাঙালির চলমান এই জীবনধারায় অষ্টম শতাব্দীর দিকে নতুন এক ধর্ম, ইসলামের আবির্ভাব ঘটে বাংলা ভূখন্ডে। পৃথিবীতে সকল ধর্ম’ই শান্তি এবং মানবতার কথা বলে। ইসলাম ধর্মও তার ব্যতিক্রম নয়। ইসলাম ধর্মের আগতরাও শান্তি ও মানবতার বানী’ই প্রচার করতে থাকে। ইসলামের সেই বানী এবং প্রচারকারীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে, বর্ণপ্রথায় পিষ্ট নিপীড়তরা স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহনে আগ্রহী হয়ে উঠে। একই সাথে বহিরাক্রমণে জীবন এবং সম্পদ নাশের আশঙ্কা থেকে বাধ্য হয়েও ইসলামে ধর্মান্তরিত হতে থাকে । এবং ধর্ম হিসেবে ইসলাম অতি দ্রুত, ব্যাপক প্রসার লাভ করতে সক্ষম হয় বাংলা অঞ্চলে। সে কারনেই, সামান্য কিছু বহিরাগত ছাড়া, সকলেই বাংলার আদি এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠী থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমান। এভাবে বাঙালির অধিকাংশরা ধর্ম বদলেছিল, কিন্তু সংস্কৃতি এবং উৎসব বদলায়নি বহুকাল।
বহু শতাব্দী ধরে দেশি বিদেশি নানা ধর্ম এবং ভাষার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর হাতে বাংলা শাসিত হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত সে-সব শাসনকালে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি এবং উৎসব একটুও ম্লান হয়নি, স্বকীয়তা হারাইনি। সংস্কৃতি চর্চার সাথে উৎসব পালন ছিল নিরবচ্ছিন্ন, নির্বিঘ্ন। বাঙালির সর্বজনীন সেই সব উৎসবের মাঝে একাত্মবোধ জাগিয়ে একাকার হয়ে উঠার সে এক অপূর্ব সামাজিক পরিমন্ডলের আবহে সমৃদ্ধ ছিল বাঙালি। বাঙালি জাতীয়তাবোধ ছিল যার মুল প্রেরনা। এভাবেই নিজ নিজ ধর্মকে অভিন্ন বাঙালি সংস্কৃতির উর্ধে রেখে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে আশ্রয় করে গড়ে উঠে বাঙালি জাতিস্বত্বা। শেকড় নির্ভর একান্ত দেশজ চিন্তা-চেতনা এবং দর্শনে আমাদের বাঙালিত্ব বা নিজস্ব সত্বা। যার ভিত্তিও ধর্মনিরপেক্ষতা। ৫৪ বছর আগে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক আমাদের নিজস্ব যে রাষ্ট্রের জন্ম, তার মুল প্রেরনা এবং ভিত্তি সেই জাতিসত্তার চুড়ান্ত রূপ বাঙালি জাতীয়তাবাদ।
একবিংশ শতকের গোড়ার দিকে ধর্মঃ দুর্ভাগ্যজনক এক অচেনা রূপে আবির্ভূত হয় আমাদের সামনে। ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য এবং কল্যানমুখী জীবন ও সমাজ ঘনিষ্ঠ মর্মার্থ পাশ কাটিয়ে, ধর্মীয় উগ্রতার বিস্তার ঘটতে থাকে। রাষ্ট্রক্ষমতা সহ সর্বস্তরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মীয় উগ্রবাদের সৃষ্ট পরিস্থিতি বাঙালির একাত্মবোধকে নস্যাৎ করে তুলে। এরাই আমাদের স্বাধীনতার প্রশ্নে ধর্মকে সামনে এনে নজিরবিহীন জীবন ক্ষয় এবং অপূরনীয় ক্ষতির কারন হয়ে উঠে। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির সকল উপাদান এবং উৎসব মূল লক্ষ্যে পরিনত হয় তাদের। বাঙালির চিরকালীন সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্মারক, শিল্প সাহিত্য, ভাষ্কর্য, সংগীত নৃত্যকলা, আসর, মেলা, পালা, জারি সারী সহ সকল উৎসব এবং কার্যক্রম নিষিদ্ধ তাদের কাছে। এমনকি মুক্ত চিন্তার চর্চা হয়ে উঠে বিপদজনক! কখনো প্রান সংশয়। উৎসব পালনের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে, মৃত্যু ঘটে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য,স্মারক এবং সমষ্টিগত সৃজনশীলতার। এরপর সামান্য পরিসরে আত্মভোলা অতি সাধারণ মানুষের একটি উৎসব চলমান ছিল। সেটি বাউল উৎসব। অতি সম্প্রতি সেই বাউলদের উপর ধর্মীয় উগ্রবাদীরা রোমহষর্ক নৃশংসতায় মেতে উঠেছে। অসংখ্য আখড়া, মাজার, বাউল স্থাপনা আক্রমণ অব্যাহত আছে। ফলে মোটাদাগে ইতিমধ্যেই সম্পুর্ন রুদ্ধ হয়ে পড়েছে সামাজিক মুল্যবোধ,অগ্রগতি এবং উৎকর্ষতার সাথে উৎসবও। নিদারুন এই স্থবিরতার মাঝে বর্তমানে বেঁচে থাকা আমাদের।
দেশ স্বাধীনের পর প্রধান দুই ধর্ম- হিন্দু এবং মুসলমানের সংখ্যানুপাতের তারতম্য বিস্তর থাকলেও, সহনীয় ভারসাম্য ছিল উভয় সম্প্রদায়ের জন্য। কিন্তু ধর্মীয় উগ্রবাদের বিস্তার এবং রাজনৈতিক, সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক সহ নানা কারনে হিন্দুরা দেশ ত্যাগ করতে থাকে। পাশ্ববর্তী হিন্দু প্রধান দেশে স্থায়ী হওয়ার অবাধ সুযোগ থাকায়, অর্ধশতাব্দী ধরে সেই প্রবনতা অব্যাহত আছে। এক্ষেত্রে ধর্মকে উর্ধে রেখে নিজস্ব সংস্কৃতি এবং উৎসবে একাত্মবোধে একাকার থাকার আবহমানকালের আমাদের সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়ার এই কারন এবং প্রেক্ষাপট অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নাই। যার দায় এড়াতে পারেনা পার্শ্ববর্তী দেশটি। ফলে হিন্দুদের সংখ্যাও অতি নগন্য বর্তমানে। ধর্মগত ভাবে হিন্দু সহ ক্ষুদ্র কিছু জনগোষ্ঠী বাদ দিয়ে, বর্তমান বাংলাদেশ নিরংকুশ সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলিম দেশ।
সেজন্য স্বাধীন বাংলাদেশের শাসক বর্গের কৃতিত্বও স্মরণে রাখতেই হয়। কারন,
বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরুর কয়েকটি বছর বাদ দিয়ে, পুরা শাসনকালে শাসক বর্গের রাজনীতি এবং রাষ্ট্র শাসনে ভোট আর ক্ষমতার বাইরে কিছুই বিবেচনা করা হয়নি। সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সংখ্যা গরিষ্ঠের অনুভূতি তোষণে ধর্মীয় পৃষ্ঠপোষকতার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপনে সক্ষম হয়েছে সকল শাসক বর্গ। মাত্র ৫০ বছরে পৃথিবীর কট্টর ধর্মীয় কোনো দেশেও, শুধু মাত্র ধর্ম চর্চা এবং আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য এত বিপুল সংখ্যাক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদাহরণ নাই। তাদের তোষণ করতে এমনকি পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু পর্যন্ত পাল্টাতে হয়। অথচ সাংস্কৃতিক কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজ, এমনকি ক্ষুদ্র পরিসরেও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র বা প্রতিষ্ঠান একটিও গড়ে উঠেনি। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড এবং উৎসব শুন্যতায় শহর গ্রাম পাড়া মহল্লা; নিঃস্ব, কাঙাল এখন। হতবাক হয়ে দেখতে হয়! সাংস্কৃতিক কোনো উৎসব আয়োজনে রাষ্ট্রের অনুমতি মিলে না। ফলে চুড়ান্ত ভাবে এই ভূখন্ডে বাঙালির আর কোনো সর্বজনীন উৎসবের অস্তিত্ব নাই। উৎসব হয়ে উঠেছে সম্পুর্ন ধর্মভিত্তিক, ধর্ম নির্ভর এবং ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব। সেদিক থেকে উৎসব আছে বটে।
শহর গ্রাম পাড়া মহল্লায় নিরংকুশ সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমানদের সে উৎসব চলে ধর্মীয় ওয়াজের নামে। মুলতঃ বিকাল থেকে মাঝরাত অবধি বিস্তর এলাকা জুড়ে চলতে থাকে শব্দ যন্ত্রের বিকট আধিপত্য। ক্ষেত্র বিবেচনায় দোকানপাট সহ বিপুল জনসমাবেশ, সাথে বেচা-কেনার মাঝে ভিন্ন এক উৎসবের চিত্র। আয়োজকদের উদ্দেশ্য মূলতঃ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের তহবিলে অর্থ সংগ্রহ। সে উৎসবের আনুষ্ঠানিকতায় সভাপতি এবং প্রধান অতিথি হিসেবে থাকেন প্রধানতঃ রাজনৈতিক প্রভাবশালী ক্ষমতাবান ব্যক্তিবর্গ। মোটা অংকের ভাড়ায় চুক্তিবদ্ধ নামকরা ধর্মীয় বক্তারা আসেন সবচেয়ে বিলাসবহুল আরামদায়ক গাড়ি চড়ে, কখনো হেলিকপ্টারে। সেসব উৎসবে ভিন্ন কিংবা নিজ ধর্মের ভিন্ন মতের বিরুদ্ধে বক্তারা যে ভাষায় এবং ভঙ্গিতে বক্তব্য দিতে থাকেন, তা শুনলে রীতিমতো রক্তক্ষরণে অন্তরাত্মা হয়ে উঠে বিবর্ণ, ফ্যাকাশে। একই সাথে নারীজাতির বিরুদ্ধে চলতে থাকে তীব্র আস্ফালন। বিভৎস অঙ্গভঙ্গির সাথে অশ্রাব্য বচন হয়ে উঠে বক্তার যোগ্যতা প্রমানের হাতিয়ার। কিন্তু বক্তার নিজ ঘরে এবং পরিবারে স্ত্রী মাতা ভগ্নী কন্যা সকলেই নারী। বক্তার সকল অর্জনে সীমাহীন ত্যাগ যে নারী জাতির, তাদের প্রতি এমন অকৃতজ্ঞ বিষোদগার পৃথিবীর অন্য কোনো অসভ্য সমাজেও অসম্ভব। বাঙালি জাতীয়তাবাদের অপরাজেয় শক্তির অনিবার্যতা; স্বাধীন সার্বভৌম এই দেশে দাঁড়িয়ে এমন চিত্র দেখা, যে-কোনো স্বাভাবিক বোধসম্পন্ন মানুষের জন্য মাত্রাহীন এক আত্মগ্লানি এবং পরাজয়।
পরিশেষে উৎসব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি উল্লেখ করতেই হয়। কারণ, রবীন্দ্র প্রসঙ্গ বাঙালি মানস থেকে মুছে যাবেনা কখনো। বাঙালির কাছে রবীন্দ্রনাথ সবসময় আধুনিক এবং প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথের কথায়: প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র, হীন একাকী – কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ; সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একাত্ম হইয়া বৃহৎ; সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ’। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধির মাঝে জীবনবোধের যে প্রকাশ তা হলো: প্রকৃত জীবনবাদী মানুষের কাছে আনন্দে বাঁচার নাম- উৎসব, সৃজনশীলতার নাম- উৎসব, সর্বজন একত্রে মিলে একাত্মবোধের নাম- উৎসব, নিত্য জেগে উঠার নাম- উৎসব। যে জীবন, সমাজ, গোষ্ঠী এবং জাতির কোনো উৎসব নাই: তারা সকল সম্ভাবনাহীন, নিষ্প্রাণ। সেখানেই পৌঁছে গেছি আমরা।
Leave a Reply